২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

add

সিলেটে গুলিবিদ্ধ অনেকেই এখনও কাতরাচ্ছেন হাসপাতালে

todaysylhet.com
প্রকাশিত ১৯ আগস্ট, সোমবার, ২০২৪ ১৯:৩০:২৭
সিলেটে গুলিবিদ্ধ অনেকেই এখনও কাতরাচ্ছেন হাসপাতালে

টুডে সিলেট ডেস্ক :: ৪ আগস্ট রোববার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা শেখ হাসিনা সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে সর্বত্র উত্তাল। সিলেটের ঢাকা দক্ষিণ-গোলাপগঞ্জ সড়কে শুরু হয়েছে বিক্ষোভ মিছিল। মিছিলে যোগ দেন কলেজ ছাত্র লিমন আহমদ (২৭)। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিজিবি আর পুলিশ বিক্ষোভকারীদের উপর হামলে পড়ে। শুরু করে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ। লিমনের মাথায় ও শরীরে বিদ্ধ হয় একে একে তিন তিনটা বুলেট। সাথে সাথে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন লিমন। লাল রক্তে ভেসে যায় পিচঢালা সড়ক।

স্থানীয়রা প্রথমে তাকে উদ্ধার করে দক্ষিণ সুরমার নর্থইস্ট হাসপাতালে নিয়ে আসেন। কিন্তু অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাকে ওসমানী হাসপাতালে পাঠানো হয়। রাতের বেলায় ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে আসলেও কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তার চিকিৎসায় গুরুত্ব দেননি। ফলে ভোরের আলো ফুটবার আগেই আইসিইউ এ্যাম্বুলেন্সে করে স্বজনরা তাকে রাজধানী ঢাকার নিউরো সায়েন্স মেডিকেল ইনস্টিটিউটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। ৫ আগস্ট বিকেলে পৌঁছার পরপরই লিমনকে রাজধানীর আগারগাঁও’র ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ভর্তির সাথে সাথেই বিশেষজ্ঞ সার্জনরা লিমনের মাথায় শুরু করেন অস্ত্রোপচার। টানা সাড়ে ছয় ঘন্টার সফল অস্ত্রোপচারের পর লিমনের মাথা থেকে বের করেন বুলেট। শংকা মুক্ত হন লিমন। এরপর তাকে পুনরায় সিলেটে নিয়ে এসে উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে লিমন উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। লিমনের জীবন এখন আশংকামুক্ত হলেও তার কথা বলা বন্ধ হয়ে গেছে। কেবলই ফ্যাল ফ্যাল করে চারদিকে তাকাচ্ছেন টগবগে লিমন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক দফা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী লিমন গোলাপগঞ্জ উপজেলার রায়ঘড় গ্রামের তাজ উদ্দিন তাজুলের পুত্র। ঢাকা দক্ষিণ ডিগ্রি কলেজের ডিগ্রি ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী লিমন পিতা-মাতার ছয় সন্তানের মধ্যে সবার বড়। পেশায় কাঠমিস্ত্রী পিতার বড় সন্তানের এমন অবস্থায় পরিবারটির সামনে এখন ঘোর অন্ধকার। নিজের রোজগার বাদ দিয়ে এখন মৃত্যুর মুখোমুখি থেকে ফিরে আসা পুত্রকে নিয়েই তাকে নিয়ে হাসপাতালে দৌঁড়াদৌঁড়ি করতে হচ্ছে।

গতকাল রোববার দুপুরে উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দশম তলায় চিকিৎসাধীন লিমনের পরিবারের সাথে এ প্রতিবেদক কথা বলেন। এ সময় হাসপাতালের বেডে থেকে চারদিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছিলেন লিমন। তার পুরো মাথার মধ্যে বাম দিক একটু নীচু। অস্ত্রোপচারের সময় মাথার ওই অংশের খুলি মাথা থেকে আলাদা করে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। সুস্থ হওয়ার পর সেটি পুনঃস্থাপন করে দেবেন চিকিৎসকগণ। তার পিতা তাজ উদ্দিন জানান, বিজিবি-পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলিতে সেদিন গোলাপগঞ্জে সাতজন নিহত হন। এসময় লিমনের মাথায় একটি, একটি বাম পায়ের নিচে লাগে এবং আরেকটি ডান পায়ের উরুতে লেগে সরাসরি বের হয়ে যায়। অপারেশন করে গুলি বের করা হলেও তার মাথার খুলির অর্ধেকাংশ আপাতত খুলে রাখা হয়েছে। পরবর্তীতে আবারও চিকিৎসকরা অস্ত্রোপচার করে মাথার খুলি লাগিয়ে দেবেন। ছেলের চিকিৎসা করাতে গিয়ে অনেক কষ্ট হলেও এখানে ফ্রি চিকিৎসা পাচ্ছি। ডাক্তার বলছেন, থেরাপির মাধ্যমে সে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠবে।

নগরের নয়াসড়ক পয়েন্টে একটি বিরিয়ানির দোকানে চাকরি করেন মো. রুবায়েত মিয়া (২১)। ৪ আগস্ট বিকেলে নয়াসড়ক এলাকায় সাধারণ ছাত্র জনতার সাথে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সংঘর্ষ শুরু হয়। ভয়ে আতংকে দোকান বন্ধ করে তিনি নয়াসড়ক জামে মসজিদের দ্বিতীয় তলায় উঠলেও নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি। ছাত্রলীগ-যুবলীগের ক্যাডাররা মসজিদের দ্বিতীয় তলায় উঠে তিনিসহ পাঁচজনকে রামদা দিয়ে কোপাতে থাকে। এক পর্যায়ে বস্তায় ভরে তাকে মসজিদের দ্বিতীয় তলা থেকে নীচতলায় ফেলে দেয় তারা। তাকে দ্রুত উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার মাথায় রামদার পাঁচটি কোপ রয়েছে। ভেঙে গেছে দুটো হাতও। ৪ আগস্ট থেকে তিনি এখনো ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। রুবায়েত সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নিজগাঁও গ্রামের মো. আক্কাস আলীর পুত্র। বৃদ্ধ পিতা আক্কাস আলী তার পুত্রের জীবন বিপন্নকারীদের বিচার দাবি করেন।

এদিকে, একই দিন নয়াসড়ক এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে অংশ নেন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী মাহবুবুর রহমান (১৯)। ওই মিছিলেও ছাত্রলীগ-যুবলীগ অতর্কিত হামলা চালায়। তারা মাহবুবুর রহমানের শরীরে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। পরে গুরুতর আহতাবস্থায় তাকেও উইমেন্স হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আহত মাহবুব সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার জগদল ইউনিয়নের কদমতলী গ্রামের মুহিবুর রহমানের পুত্র।

সিলেট ইবনে সিনা হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছেন গুলিবিদ্ধ রিয়াজ মিয়া (২১)। ৫ আগস্ট হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে পুলিশের ছোঁড়া একটি বুলেট তার ডান পায়ে এসে ঢুকে। পরে অস্ত্রোপচার করে বুলেট বেরা করা হলেও তিনি এখনো উঠে দাড়াতেই পারেননি। তিনি বলেন, আর্থিক সমস্যার দরুণ নিজে পড়ালেখা বাদ দিয়ে কৃষিকাজে মনোযোগী হন। নিজের অনেক আত্মীয়স্বজন পড়ালেখা করেও যখন চাকরি পান না আর এই কোটা নিয়ে আন্দোলন হওয়ায় তিনিও জড়িয়ে পড়েন। ওইদিন বলা যায়, বানিয়াচংয়ে দিনভর সাধারণ ছাত্র জনতার সাথে পুলিশ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। পুলিশের গুলিতে ওইদিন নয়জন প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানান তিনি।

রিয়াজ মিয়ার (২১) সোজা কথা, আমার পড়ালেখা করার সুযোগ হয়নি বলে কি হল, আমার ভাইবোন তারা-তো পড়বে। তারা যদি লেখাপড়া করেও চাকরি না পায়, তাহলে এই পড়ার কি দরকার। এজন্যেই আমি এই আন্দোলনে গিয়েছি। গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে আছি। একই হাসপাতালে ভর্তি আছেন বানিয়াচংয়ের খাইরুল ঠাকুর (২৭)। হবিগঞ্জের বৃন্দাবন কলেজের শিক্ষার্থী খাইরুলকেও ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার সাথে মিছিলে যান। এক পর্যায়ে পুলিশ বিজিবির এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ শুরু করে। তাদের ছোঁড়া একটি বুলেট তার ডান পায়ে ঢুকে বেরিয়ে যায়। স্বচক্ষে দেখা পুলিশ বিজিবির বীভৎসতার বর্ণনা দিয়ে তিনি বানিয়াচং গণহত্যার বিচারও দাবি করেন।

সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. এটিএম রাসেল মিশু জানান, গত ৩ আগস্ট থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সেখানে ৫০০ থেকে ৬০০ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। তার মধ্যে এখনো ৬ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এই আন্দোলনে যারা আহত হয়েছেন, তাদের আমরা বিনামূল্যে চিকিৎসা দিয়েছি।

ইবনে সিনা হাসপাতালের এজিএম ও হেড অব মার্কেটিং মোহাম্মদ ওবায়দুল হক বলেন, আমাদের হাসপাতালে যারাই আন্দোলনে আহত হয়ে ভর্তি হয়েছেন, তাদের আমরা ফ্রি চিকিৎসা দিয়েছি। এপর্যন্ত ৪৫০ জন চিকিৎসা নিয়েছেন আর এখনো ভর্তি আছেন ৭ জন। আর আগে ভর্তি ছিলেন ২২ জন। আমাদের এখানে গুলিবিদ্ধ হয়ে আসা রোগীদের মধ্যে সাংবাদিক এটিএম তুরাব ও গোলাপগঞ্জের ২ জনসহ মোট ৩ জন মারা গেছেন।

অন্যদিকে, ওসমানী হাসপাতালে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতদের মধ্যে ২৩৭ জন ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেন। সর্বশেষ গত শনিবার হাসপাতালটিতে ৩৪ ভর্তি ছিলেন বলে হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে।