নিজস্ব প্রতিবেদক :: গত ২১ সেপ্টেম্বর সিলেট ও সুনামগঞ্জের পৃথক স্থানে বজ্রপাতে ৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। কেবল সিলেট জেলাতেই মৃত্যু হয় ৬ জনের। বিষয়টি জনমনে ভয়ের সৃূষ্টি করেছে। জাতিসংঘের তথ্য মতে, প্রতি বছর বাংলাদেশে গড়ে ৩০০ মানুষ বজ্রপাতে মারা যায়। সে তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে মারা যায় মাত্র ২০ জন। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ বজ্রপাতের অন্যতম হটস্পট। আর সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় সিলেটে।
সাধারণত এপ্রিল-মে মাসে, বা বলা যায় বৈশাখে দেখা যায় বজ্রপাত। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে অপ্রত্যাশিতভাবে এর সময়কাল পরিবর্তীত হচ্ছে। ২০২৪ সালের এপ্রিল এবং মে মাসের প্রথম ৮ দিন মিলে ৩৮ দিনে মোট ৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে কেবল মে এর প্রথম ৮ দিনে ৪৩ জনের প্রানহানি ঘটে।
বাংলাদেশে বজ্রপাত নিয়ে গবেষণা করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এ ফারুখ। তিনি বলছেন, “বাংলাদেশে বজ্রপাতের মূল কারণ দেশটির ভৌগলিক অবস্থান। বাংলাদেশের একদিকে বঙ্গোপসাগর, এরপরই ভারত মহাসাগর। সেখান থেকে গরম আর অদ্র বাতাস আসছে। আবার উত্তরে রয়েছে পাহাড়ি এলাকা, কিছু দূরেই হিমালয় রয়েছে, যেখান থেকে ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে। এই দুই ধরণের বাতাসের সংমিশ্রণ বজ্রপাতের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে।
তিনি বলেন, ‘শীতের পর বঙ্গোপসাগর থেকে উষ্ণ বাতাস আসতে শুরু করে, অন্যদিকে হিমালয় থেকে আসে ঠান্ডা বাতাস। দক্ষিণের গরম আর উত্তরের ঠান্ডা বাতাসে অস্থিতিশীল বায়ু তৈরি হয় আর এর থেকে তৈরি হয় বজ্র মেঘের। এরকম একটি মেঘের সঙ্গে আরেকটি মেঘের ঘর্ষণে বজ্রের তৈরি হয়। এরকম উচ্চ ভোল্টের বৈদ্যুতিক তরঙ্গ যখন মাটিতে নেমে আসে, তখন সবচেয়ে কাছে যা পায়, তাতেই আঘাত করে।”
দেশের বজ্রপাত পরিস্থিতি এবং এতে হতাহতের ঘটনা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে বেসরকারি সংগঠন ডিজাস্টার ফোরাম। প্রতিষ্ঠানটির হিসাবে,২০১০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বজ্রপাতে প্রূাণ গেছে ৩ হাজার ৮৭০ জনের। অর্থাৎ প্রতিবছর ২৭৬ জনের বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছেন ২০২১ সালে, ৩৮১ জন। ওই বছরের মে মাসে বজ্রপাতে সর্বোচ্চ ১২০ জনের মৃত্যু হয়। এর আগে মে মাসে সর্বোচ্চ মৃত্যু হয় ১৫৮ জনের, ২০১৮ সালে। দেশে কোনো একটি মাসে বজ্রপাতে এত মৃত্যুর ঘটনা আর ঘটেনি। গত বছরের মে মাসে (২০২৩) ৬৮ জন এবং এর আগের বছর (২০২২) মে মাসে ৫৭ জনের মৃত্যু হয়।
খোলা প্রান্তরে বড় গাছ কেটে উজাড় করে ফেলা এবং নতুন কোনো সুরক্ষার ব্যবস্থা না রাখার কারণেই দিন দিন বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে বলে মনে করেন দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ আবদুল লতিফ খান।
তিনি বলেন, আমরা পুরোনো গাছ রক্ষা করছি না। গাছ উজাড় হলেও এর বিরুদ্ধে কোনো তৎপরতা নেই। তাহলে সুরক্ষাটা থাকবে কোথায়?’
দ্য অ্যাটমোস্ফিয়ার সাময়িকীতে প্রকাশিত ‘রিসেন্ট ক্লাইমেটোলজি অব থান্ডারস্টর্ম ডেজ ওভার বাংলাদেশ’ নামের গবেষণায় বাংলাদেশে বজ্রঝড়ের পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। এতে ১৯৮১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশের বজ্রঝড়ের উপাত্ত তুলে ধরে বলা হয়েছে, এ সময়ে দেশে সবচেয়ে বেশি বজ্রঝড় হয়েছে মে মাসে। এর গড় সংখ্যা ১৩। এরপরই আছে জুন মাস, সংখ্যা ১২। বজ্রঝড় নভেম্বর পর্যন্ত থাকছে। এ গবেষণার সঙ্গে যুক্ত আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক গণমাধ্যমে বলেন, উষ্ণতা বাড়ছে। গ্রীষ্মকালে শুধু নয়, উষ্ণতার পরিধি বর্ষার সময়েও বিস্তৃত হচ্ছে। মে মাসে বজ্রঝড়ের সংখ্যা বাড়ছে। বজ্রঝড়ের সঙ্গে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বজ্রপাত ঘটে। দেখা গেছে, সিলেট ও শ্রীমঙ্গলে বজ্রঝড়ের বার্ষিক দিনের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এ সংখ্যা যথাক্রমে ১৩৬ ও ১১৬।
বজ্রপাতে মৃত্যু বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে আর্থসামাজিক দু-একটি বিষয়ের সম্পর্ক আছে বলে মনে করেন মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক। তিনি বলেন, বজ্রপাতে মৃতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ কৃষক। আবার বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনাও বেশি ঘটে হাওর এলাকায়। প্রায়ই বৃক্ষহীন খোলা প্রান্তরে কৃষক ধান কাটার কাজ করতে গিয়ে বজ্রপাতে মৃত্যুর শিকার হচ্ছেন।
ডিজাস্টার ফোরামের ২০২৩ সালের মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত হিসাবে দেখা গেছে, এ সময় ১৩৫ জনের মৃত্যু হয়। জেলার হিসাবে সবচেয়ে বেশি ১১ জন সুনামগঞ্জ জেলায় মারা গিয়েছিল সে সময়। আর এপ্রিল মাসে ৩১ জন ও মে মাসে ৩২ জন কৃষক বজ্রপাতে মারা যান। দেখা গেছে, এ বছরের মে মাসে যে ৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের ২০ জনই কৃষক।
প্রকল্পে রোধ হচ্ছে না প্রাণহানি-
বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে সরকার একে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা দেয়। এরপর বজ্রপাতে মৃত্যু রোধে একাধিক প্রকল্পও নেওয়া হয়। এর মধ্যে একটি ছিল তালগাছ লাগানো। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের ওই প্রকল্পে ৪০ লাখ তালগাছ লাগানোর কথা থাকলেও তা ব্যর্থ হয়।
২০১৮ সালে আবহাওয়া অধিদপ্তর ৬২ কোটি টাকার বজ্রপাত সংকেত যন্ত্র ‘লাইটেনিং ডিটেকশন সেন্সর’ প্রকল্প নেয়। পরে সেন্সরগুলো নষ্ট হয়ে যায়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর এবার ১ হাজার ৩২১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নিয়ে আসছে। এর আওতায় বসানো হবে বজ্রনিরোধক দন্ড (লাইটেনিং অ্যারেস্টার), যা বজ্রপাত থেকে স্থানীয় মানুষকে সুরক্ষা দেবে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, এখন পর্যন্ত যেসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, তা হয়তো পর্যাপ্ত নয়। আমাদের নতুন কোনো ব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আসলে একের পর এক প্রকল্প নেওয়া এবং তাতে অর্থে অপচয় হলেও বজ্রপাতে মৃত্যু কমেনি। বজ্রপাতে মৃত্যু রোধে নতুন উপায় অনুসন্ধানে গবেষণাও নেই। বজ্রপাত নিরোধে বজ্রঝড়ের সময় রাবারের স্লিপার পরে সুরক্ষা পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে নেপালে এমন চর্চা শুরু হয়েছে। অথচ এত মৃত্যুর পরও আমাদের দেশে কার্যকর কোনো গবেষণা নেই। অর্থের অপচয় হয়, এমন প্রকল্পেই আগ্রহ বেশি।
Editor-in-Chief and Publisher: Mohammed Imran Ali, Executive Editor: Ahmed Ferdous Shakar, News Editor: Ahia Ahmed. E-mail: news.todaysylhet24@gimal.com
www.todaysylhet.com