ধর্ম ডেস্ক :: আমাদের সমাজে একটি কথা বহুল প্রচলিত, তা হলো- ‘অহংকার পতনের মূল’। প্রতিটি মানুষের মধ্যে দুটি শক্তি লুকায়িত থাকে। একটি ফেরেশতার চরিত্র বা ইতিবাচক গুণাবলি আর দ্বিতীয়টি হলো শয়তানি চরিত্র বা মন্দ স্বভাব। নেতিবাচক সেই স্বভাবের একটি হলো অহংকার।
মানবের মনোজগৎ তথা চরিত্রের ছয়টি শত্রু রয়েছে, যা ষড়্রিপু নামে পরিচিত— কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য। এই ষড়্রিপুর পঞ্চমটি হলো ‘মদ’ তথা দম্ভ, গর্ব, গৌরব, অহংকার। আর ষষ্ঠটি হলো ‘মাৎসর্য’ তথা ঈর্ষা, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা।
অহংকার শয়তানের চরিত্র। এই অহংকার ও হিংসাই ইবলিশকে ফেরেশতাদের শিক্ষক থেকে শয়তানে পরিণত করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সে (ইবলিশ সম্মানিত আদমকে সিজদার মাধ্যমে সম্মান করতে) অস্বীকার করল এবং অহংকার করল, পরিণতিতে সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ৩৪)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তিনটি বস্তু মানবের ধ্বংসের কারণ— প্রবৃত্তি বা নফসের পূজা, লোভ ও আত্ম-অহংকার। তিনি আরও বলেন, ‘অহংকারই হলো সবচেয়ে মারাত্মক ক্ষতিকারক।’ (বায়হাকি, মিশকাত: ৫১২২)।
আত্মগৌরব করা শুধু আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যে ব্যক্তি এ গুণ নিয়ে আল্লাহর সঙ্গে টানাটানি করে, আল্লাহ তাকে ধ্বংস করে দেন; তার প্রভাব, প্রতাপ, প্রতিপত্তি নস্যাৎ করে দেন এবং তার জীবনকে সংকুচিত করে দেন।
হাদিস কুদসিতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অহংকার আমার সম্মানের উত্তরীয় আর সম্মান হচ্ছে আমার গৌরবের পোশাক; যে ব্যক্তি এ দুটির কোনো একটি নিয়ে আমার সঙ্গে টানাটানি করে, আমি তাকে আজাবে নিক্ষেপ করি।’ (আবু দাউদ: ৪০৯০)
‘অহংকার’ মানব স্বভাবের একটি নিকৃষ্ট ও ঘৃণ্য অংশ। অহংকার কী? হাদিস শরিফে রয়েছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘অহংকার হচ্ছে সত্যকে উপেক্ষা করা এবং মানুষকে অপমান-অসম্মান ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা।’ (মুসলিম: ৯১)
আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারককে প্রশ্ন করা হলো— অহংকার কাকে বলে? তিনি বললেন, মানুষকে হেয় জ্ঞান করা। (সিয়ারু আলামিন নুবালা, খণ্ড: ৮, পৃষ্ঠা: ৪০৭)
কেন মানুষ অহংকার করে? আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মানুষ অবশ্যই সীমালঙ্ঘন করে, যখন সে নিজেকে অভাবমুক্ত মনে করে।’ (সুরা-৯৬ আলাক, আয়াত: ৬-৭)
শক্তি ও অর্থের গৌরব অহংকারের আরেকটি দিক। যার বর্ণনা কোরআন মাজিদে এসেছে, ‘অতঃপর সে (অহংকারী ব্যক্তি) কথা প্রসঙ্গে তার সঙ্গীকে বলল— আমার ধনসম্পদ তোমার চাইতে বেশি এবং জনবলে আমি অধিক শক্তিশালী।’ (সুরা-১৮ কাহাফ, আয়াত: ৩৪)
অহংকারী সম্পর্কে কোরআন কারিমে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘পৃথিবীতে দম্ভভরে পদচারণ করো না, নিশ্চয় তুমি ভূপৃষ্ঠকে কখনোই বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় তুমি পর্বত সমান হতে পারবে না।’ (সুরা-১৭ বনি ইসরাইল, আয়াত: ৩৭)।
‘অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণ করো না। নিশ্চয় আল্লাহ কোনো দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না। পদচারণে মধ্যবর্তিতা অবলম্বন করো এবং কণ্ঠস্বর নিচু করো, নিঃসন্দেহে গাধার স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর।’ (সুরা-৩১ লুকমান, আয়াত: ১৮-১৯)।
সব পাপের মূল উৎস তিনটি, এক. অহংকার যা ইবলিশের পতন ঘটিয়েছিল। দুই. লোভ, যা জান্নাত থেকে আদম (আ.)–কে বের করেছিল। তিন. হিংসা, যা আদম (আ.)–এর এক সন্তানের বিরুদ্ধে অপর সন্তানকে প্রতিশোধপরায়ণ করে তুলেছিল।
যে ব্যক্তি উক্ত তিনটি বিষয়ের অনিষ্ট থেকে বেঁচে থাকতে পারবে, সে যাবতীয় অনিষ্ট থেকে বেঁচে থাকতে পারবে। কুফরির মূল উৎস হলো ‘অহংকার’, পাপকর্মের মূল উৎস হলো ‘লোভ’, বিদ্রোহ ও সীমা লঙ্ঘনের মূল উৎস হলো ‘হিংসা’। (ইবনুল কায়্যম, আলফাওয়ায়িদ: ৫৮ পৃষ্ঠা)।
অহংকারীদের পরিণতি সম্পর্কে রাসুলে আকরাম (সা.) বলেন, ‘অহংকারী ব্যক্তিরা কিয়ামতের দিন উঠবে মানুষের রূপে পিঁপড়াসদৃশ ক্ষুদ্রাকৃতিতে। সর্বত্র লাঞ্ছনা তাদের বেষ্টন করে রাখবে। অতঃপর তাদের বুলাস নামক জাহান্নামের এক কারাগারের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। যেখানে লেলিহান অগ্নি তাদের ঢেকে ফেলবে। সেখানে তারা জাহান্নামিদের পোড়া দেহের গলিত পুঁজ-রক্তে পূর্ণ ‘তিনাতুল খাবাল’ নামক নদী থেকে গরল পান করবে।’ (তিরমিজি: ১৮৬২, ২৪৯২; মিশকাত: ৩৬৪৩, ৫১১২)।
প্রিয় নবীজি (সা.) আরও বলেন, ‘যার অন্তরে বিন্দু পরিমাণ অহংকার আছে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (মুসলিম: ৯১)।
দুনিয়াতে অহংকারের পরিণতি হলো লাঞ্ছনা-গঞ্জনা। যার অন্তরে যতটুকু অহংকার সৃষ্টি হবে, তার জ্ঞান ততটুকু হ্রাস পাবে। যদি কারও অন্তরে অহংকার স্থিতি লাভ করে, তবে তার জ্ঞানচক্ষু অন্ধ হয়ে যায়, বোধশক্তি লোপ পায়; সে অন্যের চেয়ে নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে। তার চেহারায়, আচরণে, চলনবলনে ও কাজকর্মে অহংকারের দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে। (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত: ৪০২৯)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে জাহান্নামিদের বিষয়ে খবর দেব না? তারা হলো বাতিল কথার ওপর ঝগড়াকারী, হঠকারী ও অহংকারী।’ (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত: ৫১০৬)। তাই আমাদের অহংকার পরিত্যাগ এবং অন্যকে অসম্মান এবং হেয় করা থেকে বিতর থাকা উচিত।
Editor-in-Chief and Publisher: Mohammed Imran Ali, Executive Editor: Ahmed Ferdous Shakar, News Editor: Ahia Ahmed. E-mail: news.todaysylhet24@gimal.com
www.todaysylhet.com