এহিয়া আহমদ :: সিলেটের জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, কানাইঘাট, জকিগঞ্জ উপজেলা সীমান্তবর্তী হওয়ায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন চোরাচালান আসে এই পথগুলো দিয়ে। সীমান্তবর্তী এলাকা থাকায় ওই এলাকায় চোরাকারবারীর আনাগোনা যেমন বেশি তেমনি ওই এলাকাগুলোতে চোরাচালানও বেশি। সীমান্তরক্ষী ও পুলিশ প্রসাশনের চোখ ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে নতুন নতুন পন্থা বের করে চলে এই চোরাচালান সিন্ডিকেট। পাচার হয় চোরাইকৃত মালামাল। বিজিবি ও পুলিশের ২৪ ঘণ্টার টহল থাকা সত্তে¡ও কেমন করে আসে এই চোরাচালান? তাহলে কী মাসোহারা দিয়ে চলছে এই সিন্ডিকেট? না কি আদৌ প্রশাসনকে ঘুম পাড়িয়ে চোরাকারবারীরা তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে নানা মহলে চলছে গুঞ্জন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন ধরনের চোরাই মালামাল আসে এইসব সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে। মাদক থেকে শুরু করে গরু পর্যন্ত বাদ যায় না চোরাচালান হতে। যেমন, ভারতীয় প্রসাধনী সামগ্রী, মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, পেয়াজ, আদা, চিনি, গরু, মহিষ, বিভিন্ন গাড়ির বিভিন্ন রকমের যন্ত্রাংশ বা পার্টস আসে এসব এলাকা দিয়ে। ভারত থেকে নিয়ে আসা চোরাই গাড়িগুলোর বেশিরভাগ সীমান্তবর্তী এলাকায় চলাচল করে। আবার বাকী চোরাইকৃত মালামালগুলো বিভিন্ন পন্থায় শহরে বা রাজধানীতে পাচার করা হয়। সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে ভারতীয় চোরাইকৃত মালামাল বিক্রিতে চোরাকারবারীদের মুনাফা আসে দ্বিগুনের থেকেও বেশি।
দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সিলেটে চোরাচালান সিন্ডিকেটের হাতবদল হয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে এই চোরাচালান সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে ছিল যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের হাতে। কিন্তু এখন চোরাচালানে ‘হাত বদল হয়েছে ঠিকই কিন্তু রুট বদল হয়নি’। আগে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা ছিল কিন্তু এখন যুবদল ও ছাত্রদলের নেতারা এই চোরাচালান সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে বিভিন্ন মহলের অভিযোগ রয়েছে।
সূত্রমতে, ক্ষমতার পালাবদলের পর ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে চলে যান। এ সুযোগে সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ নেন যুবদল-ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। তাঁদের নেতৃত্বেই এখন সীমান্ত এলাকা থেকে চোরাই চিনি ট্রাকে করে এনে নিরাপদে সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হচ্ছে। এর বিনিময়ে যুবদল ও ছাত্রদলের নেতারা মোটা অঙ্কের টাকা নিচ্ছেন।
বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে জানা গেছে, সীমান্তে অবৈধ চিনির পথ প্রায় নয় মাস ধরে খোলা। ভারত থেকে যাতায়াত সুবিধায় সিলেটের বিয়ানীবাজার, জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ, সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার, ছাতক, সুনামগঞ্জ সদর, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর ও নেত্রকোনার দুটো সীমান্ত উপজেলা দিয়ে চিনি প্রবেশ করে বাংলাদেশে। এর মধ্যে সিলেট ও সুনামগঞ্জে চোরাই পথে চিনির ব্যবসা হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। চোরাচালানের সব পথ খোলা থাকায় ‘পার’ করে দেওয়া নিয়ে আরেক বাণিজ্যের সূত্রপাত ঘটেছে। এতে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ রয়েছে যুবদল, ছাত্রদল, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গদের।
সিলেটের সচেতন মহল বলছেন, প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে প্রতিদিন এত চোরাই মালামাল আসা মোটেই সম্ভব না। নিশ্চয়ই প্রশাসনকে অবহিত করে মাসোহারা দিয়ে চলছে এই চোরাচালান। নতুবা সীমান্তে এত নজরদারি থাকার পরও কীভাবে ভারত থেকে বাংলাদেশে আসছে ওইসব চোরাই পণ্য। লাইন দিয়ে প্রতিদিন মধ্যরাত থেকে সকাল ৮-৯টা পর্যন্ত চলে চোরাকারবারের দৌরাত্ম্য। যেটা পরিস্থিতি বুঝে সময় সুযোগ দেখে ‘বাড়ে আবার কমেও’।
অনুসন্ধানে সীমান্তবর্তী এলাকার স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সিলেটের গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর ও কানাইঘাট উপজেলার সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন কোটি টাকার উপরে চিনি আসে। আবার কোনো কোনো সময় শুধু চিনি নয় সাথে আসে গরু, মহিষ, কাপড়সহ নানা প্রসাধনী সামগ্রী। এসব চোরাইকৃত মালামাল জৈন্তাপুর-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়ক ও ভোলাগঞ্জ-কোম্পানীগঞ্জ-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়ক দিয়ে নগরীর পাইকারি বাজার কালীঘাটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। এরআগে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁদের অনুসারীরা পাহারা দিয়ে প্রতিদিন মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত চোরাই পণ্যের ট্রাক শহরে ঢোকাতেন। এখন এ কাজে হাতবদল হলেও রুট আর বদল হয়নি। পূর্বের রুটে এখন প্রতিদিন চোরাই মালামাল প্রবেশের ঘটনা ঘটছে।
সীমান্তবর্তী উপজেলা থেকে প্রতিরাতেই চোরাই পণ্যবাহী ট্রাক সিলেট নগরী হয়ে দেশের নানা জায়গায় যায়। এ সকল চোরাইপণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আসে ভারতীয় চিনি। কম পুঁজিতে বেশি লাভ হওয়ায় চোরাকারবারীদের চিনিতে আগ্রহ বেশি। ভারত থেকে ৪ হাজার টাকায় কেনা একটি চিনির বস্তা সিলেটে বিক্রি হয় সাড়ে ৫ থেকে ৫ হাজার ৮শ’ টাকায়। অনেকেই এসব চোরাচালান করে কোটি কোটি টাকার মালিক হলেও থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর যারা আটক হন, তারা বেশিরভাগই লাইনম্যান বা চোরাই মাল বহনকারী। কিন্তু চোরাইপণ্য পাচারের পেছনের মাস্টারমাইন্ডরা থেকে যায় আড়ালে।
একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চোরাইপথে চিনি বহনকারী এপার-ওপারের সবাই দিনমজুর। রাতে অথবা ভোরে এক ঘণ্টায় সারা দিনের মজুরি মেলায় এপার-ওপারের অধিকাংশ শ্রমিক এ কাজে জড়িয়ে পড়ছেন। মধ্যরাত থেকে ভোরের মধ্যে দুটি আঞ্চলিক মহাসড়ক দিয়ে ট্রাক ও পিকআপে চোরাই চিনি সিলেটে ঢোকে। এসব মহাসড়ক দিয়ে চিনি এখন ট্রাকপ্রতি ৫ থেকে ৮ হাজার টাকায় পার করিয়ে দিচ্ছে যুবদল ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের কয়েকটি সিন্ডিকেট। সিলেট শহরে ঢোকার পর অধিকাংশ চিনি ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক দিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ট্রাকে করে যায়। এসব ট্রাক দক্ষিণ সুরমার বাইপাস এলাকাসহ কিছু স্থানে আটকিয়ে যুবদল ও ছাত্রদলের কিছু নেতাকর্মী আরেক দফা ট্রাকপ্রতি চাঁদা আদায় করে থাকেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পুলিশের অনুপস্থিতির সুযোগে এ চাঁদাবাজি এখন অনেকটা ‘ওপেন সিক্রেট’ হয়ে পড়েছে।
৫ আগস্টের আগে চিনিসহ সকল চোরাই পণ্যের সঙ্গে জড়িত ছিলো সিলেট আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। আওয়ামী সরকার পতনের পর চোরাচালানের হোতা ছাত্রলীগ নেতারাও আত্মগোপনে চলে যান। সীমান্ত এলাকায় বিজিবি ও পুলিশের নজরদারিও বৃদ্ধি পায়। এতে পাচার অনেকটা কমে যায়। হাসিনা সরকার পতনের পর সচেতন সিলেটবাসী মনে করেছিলেন চোর কারবারিরা এবার নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বেন, অবৈধ এই চোরাচালান কারবার বন্ধ হবে। কিন্তু হয়নি- চোরাচালান মধ্যখানে কিছুটা কম থাকলেও এখন আবার বেপোরোয়াভাবে চিনিসহ বিভিন্ন রকমের পাচার শুরু হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, হাতবদল হয়ে এবার চিনিসহ সকল চোরাই পণ্যের কারবার চলে এসেছে সিলেটের কতিপয় যুবদল-ছাত্রদল নেতার হাতে। এখন শহরে নির্বিঘেœ চোরাই চিনির প্রবেশ ঘটাতে যুবদল ও ছাত্রদলের কিছু নেতাকর্মী পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছেন। এ ছাড়া জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুর, সিলেট নগরের শাহপরান ও আম্বরখানা এবং দক্ষিণ সুরমা উপজেলার বাইপাস এলাকায় ট্রাক আটকে যুবদল ও ছাত্রদলের নেতাকর্মী হিসেবে পরিচয় দিয়ে অনেকে মোটা অংকের চাঁদা আদায়ও করছেন। তবে বিষয় নিয়ে হার্ডলাইনে বিএনপি ও দলটির অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোর হাই কমান্ড। শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাÐে জড়িত থাকার দায়ে ইতোমধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। এসব বিষয়ে কোনো ছাড় দেওয়া হবে বলেও পরিষ্কারভাবে জানিয়েছে বিএনপি।
জৈন্তাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল বাশার মোহাম্মদ বদরুজ্জামান জানান, জৈন্তাপুর থানায় উনি নতুন যোগদান করেছেন। রবিবার পর্যন্ত তিনি ভারতীয় চোরাইকৃত বিভিন্ন প্রসাধনী সামগ্রীসহ চোরাই চিনিতে ৭টি মামলা দায়ের করেন। পুলিশ চৌকশ রয়েছে, অভিযোগ পাওয়া মাত্রই সাথে সাথে অভিযান পরিচালনা করছে।
কানাইঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আব্দুল আউয়াল জানান, ‘আমি এই থানায় সদ্য যোগদান করেছি। যেহেতু কানাইঘাট সীমান্তবর্তী এলাকা সেহেতু সীমান্তে পুলিশের টহল জোরদার করা হয়েছে। আর চোরাচালান বন্ধে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
এ ব্যাপারে কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উজাহের আল মামুন হাসান বলেন, ‘আমি নতুন যোগদান করেছি। যোগদানের পর আমরা পাথর ও বালুর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছি। আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে। পাশাপাশি কেউ কোনো অভিযোগ দিলে আমরা তাও দেখছি।’
এ ব্যাপারে গোয়াইনঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সরকার তোফায়েল জানান, ‘আমি গোয়াইঘাট থানায় নতুন যোগদান করেছি। এখানে যোগদানের পর চোরাচালান সংক্রান্ত বিষয়ে অবগত হয়েছি। আমরা গোয়াইনঘাট থানাপুলিশ মাদক ও চোরাচালান বন্ধে সক্রিয় থাকবে।’
সিলেট জেলা পুলিশের মিডিয়া ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তার অফিসিয়াল নাম্বারে একাধিকবার ফোন দিলে তিনি ফোনকল রিসিভ করেন নি।
বক্তব্যের জন্য সিলেট জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমানের মুঠোফোনে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে একাধিকবার ফোন দিলে মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
Editor-in-Chief and Publisher: Mohammed Imran Ali, Executive Editor: Ahmed Ferdous Shakar, News Editor: Ahia Ahmed. E-mail: news.todaysylhet24@gimal.com
www.todaysylhet.com