এহিয়া আহমদ :: বেশিরভাগ সময় দেখা যায় পাহাড়-টিলা কাটা হয় রাতে। রাতেই সরিয়ে নেয়া হয় টিলা কাটার মাটিগুলো। আবার ওই মাটি ট্রাকভর্তি করে দেদারসে বিক্রি হয় বিভিন্ন জায়গায়। অনেকাংশে দেখা যায়, টিলা ঘেঁষে ছোট-বড় আঁকাবাঁকা রাস্তা হওয়ায় ভ্যান, ঠেলাগাড়ি ও ট্রলি দিয়ে টিলার মাটি বিক্রি করা হয়। কিন্তু এবার সিলেটে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র।
নির্ভয়ে ও নির্দ্বিধায় দিনে-দুপুরে কাটা হচ্ছে টিলা। তিন-চারজনের একটি গ্রুপ দেদারসে টিলা কাটছেন। আবার দু’টি ভ্যানে করে টিলার মাটিগুলো এক স্থান থেকে অন্যস্থানে সরিয়ে নিচ্ছেন তাদের সহযোগীরা। এভাবেই প্রতিনিয়ত কাটা হচ্ছে টিলা আর লুট হচ্ছে টিলার মাটি। তারপর ধসে পড়ে টিলা। ওই ধসে পড়া টিলার মাটির নিচে পড়ে ঘটছে প্রাণহানি। টিলা কাটার ওইসব স্থানে গড়ে তোলা হচ্ছে আলিশান ভবন, আবাসিক বাসা-বাড়ি কিংবা হাউজিং প্রকল্প। এই দৃশ্য সিলেট সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ৮নম্বর ওয়ার্ডের হাওলদারপাড়ার রাইফেল ক্লাব টিলার।
স্থানীয়রা জানান, হাওলদারপাড়ার রাইফেল ক্লাব টিলাটি কাটার নেতৃত্ব দিচ্ছেন কাচা মিয়ার ছেলে ইমরান আহমদ। ইমরান তার লোকজন নিয়ে মেতেছেন এই টিলা কাটার মহোৎসবে। তবে এ ব্যাপারে প্রতিবাদ করতে গেলে ইমরান বিভিন্নভাবে হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন স্থানীয় প্রতিবাদকারীদের। তার ভয়ে এখন প্রতিবাদ করতে হিমশিম খাচ্ছেন স্থানীয়রা।
সরেজমিনে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, একটি সময় সিলেটের বিভিন্ন এলাকা সুউচ্চ টিলাবেষ্টিত ছিল। কিন্তু এখন সেই এলাকাগুলোতে দিন দিন ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠেছে আবাসিক ভবন, প্লট কিংবা কোনো হাউজিং প্রকল্প। সিলেট নগরীর বিভিন্ন এলাকাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি টিলাকাটা হচ্ছে সিটি করপোরেশনের নতুন অন্তর্ভূক্ত এলাকাগুলো। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- টুকেরবাজারের পীরসাহেবের টিলা, ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের নিতু দেবনাথের বাড়ির পূর্ব পাশের টিলা, আখালিয়া বড়গুলের ওসমান মিয়ার বাড়ির পূর্ব পাশের টিলা, বড়গুলের দেবোত্তর সম্পত্তিতে থাকা রাবার বাগান টিলা, কালীবাড়ি এলাকার টিলা, হাওলাদার পাড়ার মজুমদার টিলা, রাইফেল ক্লাব টিলা, ব্রাহ্মণশাসন এলাকার টিলা, দুস্কি বাজারের দক্ষিণ পূর্ব পাশের টিলা, মোহাম্মদি আবাসিক এলাকার টিলা, উপরপাড়া হেলাল সার্ভেয়ারের বাড়ির পশ্চিম পাশের টিলা, নালিয়া মাদরাসা টিলা, বাটা বাবু লালের টিলা, যুগীপাড়া ফার্মের টিলা, খাদিমপাড়া ইউনিয়নের দলইপাড়ার টিলা, বালুচর জোনাকী এলাকার বিভিন্ন টিলাসহ বিভিন্ন স্থানে অবাধে নির্বিচারে চলছে এই টিলাকাটার মচ্ছব। পরিবেশবান্ধব কর্মীরা লাগাতার আন্দোলন করেও বন্ধ করতে পারছেন না টিলা ধ্বংসযজ্ঞ। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করেও সুফল পাচ্ছেন না- এমন অভিযোগ তাদের।
অনুসন্ধানকালে স্থানীয়রা জানান, ২০২৩ সালে সিলেট সিটি করপোরেশন ২৭টি ওয়ার্ড থেকে বর্ধিত হয়ে ৪২টি ওয়ার্ডে উন্নীত হয়। নগর বর্ধিত হওয়ার কারণে নতুন অন্তর্ভুক্ত এলাকাগুলোর ভূমির দাম বেড়ে দিগুণ হয়েছে। আর এ কারণে সম্প্রতি নতুন অন্তর্ভুক্তি এলাকায় টিলাকাটাও বেড়েছে আগের চেয়ে কয়েকগুন বেশি। টিলার মাটি কিনতে হলে আগে থেকেই চুক্তি করতে হয়। আর এই মাটি ব্যবহার করা হয় সিলেট নগরী ও শহরতলীর নতুন বাসা-বাড়ি তৈরিতে। আবার কোনো কোনো সময় এই টিলাগুলো কেটে প্লট ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানোর জন্যও নানা পন্থা অবলম্বন করা হয়।
সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইফতেখার আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘পরিবেশের ক্ষতি করলে, পরিবেশ তা ফিরিয়ে দেয়। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় টিলার গুরুত্ব আকাশচুম্বি। কিন্তু কিছু সংখ্যক অসাধু লোকেরা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে টিলা কাটছে। আমরা অভিযোগ পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছি। কিন্তু টিলা কাটা রোধে আমাদের পাশাপাশি স্থানীয়দেরও সচেতন হতে হবে।’
সেইভ দ্যা হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট-এর প্রধান নির্বাহী আব্দুল হাই আল-হাদী বলেন, ‘সিলেটের পাহাড়-টিলা রক্ষায় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ। দায়িত্বশীলদের অনেকেই পাহাড়-টিলা রক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করেন না। তাই কোনোভাবেই টিলা কাটা থামানো যাচ্ছে না। টিলা কাটার সাথে প্রভাবশালীদের সম্পৃক্ততা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জনপ্রতিনিধি বা যারা এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি তাঁরা টিলা সংরক্ষণে ভূমিকা রাখার কথা। কিন্তু না! সেখানে তারা টিলা কেটে ধ্বংস করছেন। তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনা উচিৎ।’
পরিবেশ অধিপদপ্তর সিলেটের সহকারী পরিচালক ফেরদৌস আনোয়ার বলেন, ‘টিলা কাটার ব্যাপারে জিরো টলারেন্স। অভিযোগ পেলেই দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। টিলা কাটার অভিযোগে গত একবছরে অনেক মামলা ও জরিমানাও করা হয়েছে। আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’
সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. শের মাহবুব মুরাদ বলেন, ‘পরিবেশ রক্ষায় টিলা কাটা বন্ধ করা না গেলে প্রকৃতির বৈরিতা আরও বাড়তে পারে। কোনো অবস্থায় টিলা কাটা বরদাশত করা হবে না। অভিযোগ পেলে দ্রুত অভিযান পরিচালনা করা হয়। তাছাড়া আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’