নিজস্ব প্রতিবেদক :: সিলেটে ছাত্রজনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে প্রকাশ্য দিবালোকে দায়িত্বপালনরত অবস্থায় পুলিশের গুলিতে নির্মম ভাবে নিহত দৈনিক নয়াদিগন্তের সিলেট ব্যুরো প্রধান এটিএম তুরাম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) সাবেক অতিরিক্ত উপ-কমিশনার সাদেক কাওসার দস্তগীরকে ৫ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
বৃহস্পতিবার বিকাল সোয়া ৫টার দিকে তাকে সেনা ও পুলিশের কড়া নিরাপত্তায় আদালতে তোলা হয়। পরে পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে বিজ্ঞ বিচারক দস্তগীরকে ৫ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার নির্দেশ দেন। এর আগে বুধবার বিকেল ৫টার দিকে শেরপুর জেলার একটি এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
তার আগে ১৭ নভেম্বর রাতে এ মামলার আরেক পুলিশ আসামি কনস্টেবল উজ্জ্বলকে ঢাকা থেকে পিবিআই গ্রেফতার করে । পরে আদালতের নির্দেশে তাকে ৫ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন।
জানা যায়, বিগত ১৯ জুলাই বাদ জুম্মা সিলেট নগরের কোর্টপয়েন্টে বিএনপির বিক্ষোভ মিছিলের ছবি তোলার সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হন দৈনিক নয়া দিগন্তের সিলেট ব্যুরো প্রধান এটিএম তুরাব। তুরাব সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার পৌরশহরের ফতেহপুর গ্রামের মাস্টার আব্দুর রহিমের কনিষ্ট পুত্র। তিনভাই এক বোনের মধ্যে তুরাব ছিলেন সবার ছোট। সিলেট নগরের যতরপুরে মা আর ভাইদের সঙ্গে তিনি বাস করতেন। মাত্র আড়াই মাস আগে বিয়ে করেছিলেন তিনি। মেহেদীর রঙ মোছার আগেই বিধবা হয়ে যান তাঁর যুক্তরাজ্য প্রবাসী সহধর্মিনী। সাংবাদিকতা জীবনের প্রায় ১৫ বছরে জাতীয় পর্যায়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার, ব্রাক মাইগ্রেশন অ্যাওয়ার্ডসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু অর্জন ছিলো তাঁর। সিলেট প্রেসক্লাব, বিয়ানীবাজার প্রেসক্লাব, ফটো জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এটিএম তুরাব। গোলাপগঞ্জ বিয়ানীবাজার সংবাদ, সপ্তাহজুড়ে’সহ একাধিক গণমাধ্যমে তিনি কাজ করেছেন।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে গত ১৯ জুলাই দুপুরে নগরের বন্দরবাজার এলাকা থেকে মিছিল বের করে বিএনপি ও অঙ্গসহযোগী সংগঠন। সেখানে পুলিশের সাথে সংঘর্ষ বেঁধে যায় মিছিলকারীদের। পুলিশ মিছিলকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে গুলি ছোঁড়ে। ওইদিন আরও কয়েকজন সহকর্মীর সাথে সেখানে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন তুরাব। আর সেখানেই গুলিবিদ্ধ হন তিনি। সংঘর্ষ শুরুর কিছুক্ষণ পর সেখানে উপস্থিত সহকর্মীরা দেখেন তুরাব মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন। তৎক্ষণাৎ তাকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান সহকর্মীরা। পরে সেখান থেকে তাকে ইবনে সিনা হাসপাতালে নেওয়া হয়। ওই দিন সন্ধ্যায় হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থান তুরাব শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পরদিন ২০ জুলাই ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তুরাবের মরদেহের ময়না তদন্ত হয়। সেদিন বিকেলে গ্রামের বাড়ির কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়।
ঘটনার পর দিন ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ও সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান শামসুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান ‘নিহতের শরীরে ৯৮টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। গুলিতে তার লিভার ও ফুসফুস আঘাতপ্রাপ্ত হয়। মাথায় ঢিলের আঘাতও ছিল। এ কারণেই তাঁর মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে।
এদিকে, এ ঘটনার পর সিলেটের সাংবাদিক সমাজ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সিলেট প্রেসক্লাব, সিলেট জেলা প্রেসক্লাব, সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাব, ফটো জার্নালিষ্ট এ্যাসোসিয়েশন সহ সিলেটের সাংবাদিকদের প্রতিনিধিত্বশীল ৭টি সংগঠন যৌথভাবে প্রতিবাদ করে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দ্রæত গ্রেপ্তার এবং শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানায়। এরপর বিভিন্ন সময়ে পুলিশ কমিশনারের কাছে স্মারকলিপি প্রদানসহ নানা কর্মসূচি পালন করেন সাংবাদিকরা।
ঘটনার পরপরই কোতায়ালি থানা পুলিশ বাদী হয়ে ৩৪ জনকে আসামি করে কোতায়ালি থানায় একটি মামলা করেন। এতে পুলিশের কাউকে আসামির তালিকায় রাখা হয়নি। বেশিরভাগ বিএনপি জামায়াতের নেতাকর্মীদের আসামি করা হয়। এতে ক্ষুব্দ হয় নিহতের পরিবার। ক্ষোভ প্রকাশ করেন সিলেটের সাংবাদিক নেতৃবৃন্দরা। ফলে ঘটনার এক মাস পর ১৯ আগস্ট নিহতের ভাই আবুল হাসান মো. আযরফ (জাবুর) বাদী হয়ে সিলেট অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালছাড়াও এসএমপির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (ক্রাইম উত্তর) মো. সাদেক দস্তগির কাউসার, সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার আজবাহার আলী শেখ, হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়তি আওয়ামীলীগের নেতারা সহ ১৮ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। সেই সঙ্গে অজ্ঞাতনামাও কয়েকজনকে আসামি করা হয়।
মামলা দায়েরের পর গত ২৩ সেপ্টেম্বর ভোররাতে মামলার ৬নং আসামি- ঘটনার সময়কার সিলেট কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি মঈন উদ্দিন শিপনকে তার বাড়ি থেকে বিজিবি আটক করে। তবে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। এ অবস্থায় মামলাটির তদন্তের জন্য পিবিআইকে দায়িত্ব দেন আদালত। ফলে ৮ অক্টোবর কোতায়ালি থানা পুলিশ মামলার নথিপত্র পিবিআইর কাছে হস্তান্তর করে। পরদিন ৯ অক্টোবর মামলার নতুন তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইর পরিদর্শক মোহম্মদ মুরসালিনের নেতৃত্বে একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। সেখানে সাংবাদিক নেতারা উপস্থিত থেকে তাদেরকে সহযোগিতা করেন। কিন্তু এরপর আর এ মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে কিছুই জানা যাচ্ছে না।
এর পর গত ১৭ নভেম্বর ঢাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় মামলার এজহারভূক্ত আসামী পুলিশ সদস্য উজ্জ্বল সিনহাকে। তাকে রিমান্ডে নেয় পিবিআই। কিন্তু রিমাণ্ডের তিনি কি তথ্য দিয়েছে তা এখনো অজানা।
এদিকে, পুলিশ সদস্য উজ্জলকে গ্রেফতার করা হলেও এখনো বহাল তবিয়তে চাকুরী করছেন পুলিশ সুপার (অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত) আজবাহার আলী শেখ, সহ মামলার অভিযুক্ত পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তারা। রহস্যজনত কারনে তাদেরকে গ্রেফতার ও চাকুরীচ্যুৎ করা হচ্ছে। ফলে নিহতের পরিবার ও সাংবাদিক সমাজে বিষয়টি নিয়ে দিন দিন ক্ষোভ বাড়ছে।
Editor-in-Chief and Publisher: Mohammed Imran Ali, Executive Editor: Ahmed Ferdous Shakar, News Editor: Ahia Ahmed. E-mail: news.todaysylhet24@gimal.com
www.todaysylhet.com