
ঠিকাদার-সওজ ‘সমঝোতা’য় সরকারের রাজস্ব গচ্চা
টুডে সিলেট ডেস্ক :: সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কে সুরমা নদীর ওপর স্থাপিত লামাকাজী সেতুর টোল আদায় আগের বারের চেয়ে প্রায় অর্ধেক দরে ইজারা দেওয়া হয়েছে। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ‘সমঝেতার’ মাধ্যমে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) কর্তৃপক্ষ ইজারা দেয় বলে অভিযোগ উঠেছে। তিন অর্থবছরের জন্য সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে মেসার্স মাহি এন্টারপ্রাইজকে আট কোটি পাঁচ লাখ ১০ হাজার টাকার সঙ্গে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ১০ শতাংশ আয়কর যুক্ত করে সর্বমোট ১০ কোটি ৬ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ টাকায় ইজারা দিতে শর্ত সাপেক্ষে অনুমোদন দেওয়া হয়। সেতুর ইজারা গ্রহিতা মেসার্স মাহি এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী যুবদল নেতা মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বিএনপি নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী গ্রুপের একনিষ্ট নেতা বলে জানা গেছে।
এতে সিলেট সওজ’র কতিপয় কর্তা-ব্যক্তির পকেট ভারী হলেও বড় অঙ্কের রাজস্ব কমবে সরকারের। সওজ কর্মকর্তাদের এহেন কর্মে ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষও। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন পরিবহণ মালিক-শ্রমিক নেতারাও।
সুনামগঞ্জ জেলা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুল মুকিত মকুল ও সিলেট জেলা বাস মিনিবাস কোচ মাইক্রোবাস শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ময়নুল ইসলামের অভিযোগ, এখানে ‘সমঝোতার ভিত্তিতে’ এবং সওজের কর্মকর্তারা ‘কমিশন পেতে’ কম মূল্যে ইজারার বন্দোবস্ত করছেন। এতে মোটা অংকের রাজস্ব হারাবে সরকার।
জানা যায়, তিন বছরের মেয়াদে আগের বার প্রতিদিন এক লাখ ৩৬ হাজার ৮০১ টাকা করে ইজারাদারের কাছ থেকে টোল পেয়ে আসছিল সওজ। তিন বছরের ইজারার মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২৪ সালের জুনে। এরপরও সওজ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে টোল আদায় চলছিল। এমতাবস্থায় সওজ সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী আমির হোসেন স্বাক্ষরিত ২ ডিসেম্বরের এক প্রতিবেদনে ‘রিয়ার অ্যাডমিরাল এম এ খান লামাকাজী সেতু’র কাজ আগের বারের চেয়ে ৪৬ দশমিক ২৫ ভাগ কমে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এতে একই মেয়াদের জন্য প্রতিদিন ৭৩ হাজার ৫২৫ টাকায় দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
কম মূল্যে ইজারা দেওয়ার কারণ হিসেবে প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়, সুনামগঞ্জ জেলার পাগলা-জগন্নাথপুর-আউশকান্দি সড়কের রাণীগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর উপর নির্মিত ‘রাণীগঞ্জ’ সেতু ২০২২ সালের ৭ নভেম্বর চালু হয়। ওই সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচলের কারণে বর্তমানে বিশ্বনাথ উপজেলার ‘লামাকাজী’ সেতু দিয়ে গাড়ি চলাচল ‘কমে’ গেছে। এজন্য আগের মত টোল ‘আদায় হচ্ছে না।’
যদিও এ পথে চলাচলকারী পরিবহন শ্রমিকরা বলছেন, এ পথে গাড়ি কমেনি। এ কারণে ইজারার অর্থ অর্ধেকের মত কমে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
এদিকে, সওজ সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী আমির হোসেনের সুপারিশে ১২ জানুয়ারি সওজ রক্ষণাবেক্ষন সার্কেলের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. জিকরুল হাসান স্বাক্ষরিত চিঠিতে রিয়ার অ্যাডমিরাল এম এ খান লামাকাজী সেতু’র টোল আদায় কার্যক্রম তিন অর্থবছরের জন্য সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে মেসার্স মাহি এন্টারপ্রাইজকে আট কোটি পাঁচ লাখ ১০ হাজার টাকার সঙ্গে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ১০ শতাংশ আয়কর যুক্ত করে সর্বমোট ১০ কোটি ৬ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ টাকায় ইজারা দিতে শর্ত সাপেক্ষে অনুমোদন দেওয়া হয়।
সূত্র জানায়, বিপুল পরিমান রাজস্ব আয়ের সেতুটি অনলাইনে টেন্ডারের কথা থাকলেও কৌশলে দু’একটি প্রিন্ট পত্রিকায় টেন্ডার আহ্বান করে সড়ক ও জনপদ বিভাগ সিলেট। সওজ সিলেটের কর্মকর্তাদেরর পছন্দনীয় একটি প্রতিষ্ঠানকে ইজারা প্রদানে মরিয়া হয়ে ওঠেন। প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামও গেপেনে ঢাকায় প্রেরণ করা হয়। কমমূল্যে ইজারা দিয়ে পূর্বের ইজারা মূল্য ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, অনেক বড় বড় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এ সেতুর ইজারায় অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিলেও সওজ সিলেটের গোপনীয়তার কারণে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। ফলে প্রতিযোগীতাহীনভাবে পূর্বের টেন্ডারের মূল্যের চেয়ে প্রায় ৯ কোটি টাকা কমে ইজারা দেয়া হয়।
সেতুটির দায়িত্বে থাকা সড়ক উপ-বিভাগ সিলেটের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. শাহীদুল ইসলাম বলেন, তিন অর্থবছরের টোল আদায়ের জন্য ১৫ জানুয়ারি লামাকাজী সেতুর ইজারাদার মেসার্স মাহি এন্টারপ্রাইজকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে বিস্তারিত তিনি জানাতে পারেননি।
সওজ উপ-বিভাগ সিলেটের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. সালাহ উদ্দিন সোহাগ বলেন, আমি এখানে নতুন এসেছি। মাত্র ২০/২২ দিন হয় যোগদান করেছি। সেতুটি ইজারা দেওয়ার বিষয়ে সওজ সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী ভাল বলতে পারবেন।
সমঝোতার মাধ্যমে সেতু ইজারা দেওয়ার হয়েছে- এমন অভিযোগের উত্তরে সড়ক জোন সিলেটের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবু সাঈদ মো. নাজমুল হুদা বলেন, এ বিষয়ে সড়ক ডিভিশন জানে, তাদের জিজ্ঞাসা করেন। তারা ভালো বলতে পারবেন।
সেতুর ইজারা গ্রহিতা মেসার্স মাহি এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী যুবদল নেতা মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন রাজু বলেন, ৮ কোটি পাঁচ লাখ ১০ হাজার টাকার সঙ্গে ২৫ শতাংশ ভ্যাট-ট্যাক্সসহ সর্বমোট ১০ কোটি ৬ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ টাকায় ইজারা দিতে শর্ত সাপেক্ষে অনুমোদন দেওয়া হয়। ১৫ জানুয়ারি থেকে টোল আদায়ের জন্য বুঝিয়ে দিয়েছে সওজ।
তিনি বলেন, এ নিয়ে ১৪ বার দরপত্র হয়েছে। ১৪ তম বারে তিনি সর্বোচ্চ দরদাতা হয়েছেন। এরআগে অংশ নেওয়া ইজারা প্রতিষ্ঠান ভ্যাট-টেক্সসহ ৯ কোটি ৫৭ লাখ টাকা দর দেন।
এখানে কোনো সিন্ডিকেট হয়নি দাবি করে ইজারাদার আরও বলেন, মূলত; রাণীগঞ্জ সেতু দিয়ে যানচলাচল শুরু হলে এই সেতুর আয় কমে যায়। এখন ছাতক থেকে মালামাল টানা যানবাহন বেশিরভাগ ওই সেতু ব্যবহার করে। যে কারণে প্রতিদিন ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা আয় কমে গেছে এই সেতুতে। এছাড়া অর্থ বছরের হিসাব করে ১০৯৫ দিন থেকে ১৯৮ দিনের টাকা বাদ দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে দরপত্রের ৪ কোটি টাকা পে-অর্ডারের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়েছে। অনেকে কম টাকায় নিতে চাচ্ছিলেন। সব কিছু বিবেচনায় দরপত্রে তার দেওয়া সর্বোচ্চ মূল্য বেশি হয়ে গেছে মনে করছেন তিনি।
সেতুটি ইজারার মেয়াদোত্তীর্ণের পর আওয়ামী লীগের নেতারা মাত্র ৫ কোটি টাকায় ইজারা নেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছিলে শুনেছি।
সিলেট সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আমির হোসেন বলেন, সেতুটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২৪ সালের ৩০ জুন। ইতিমধ্যে সেতুর টোল আদায় বন্ধ করতে আন্দোলন চলছে। সওজের কর্মকর্তা-কর্মচারিরা টোল আদায় করতে গিয়ে হেনস্তার শিকার হন। এরইমধ্যে সেতুটি ১৪ বার দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। প্রধান প্রকৌশলীর নির্দেশনা অনুযায়ী শেষ বারে ১৪ তম (চ‚ড়ান্ত) দরপত্রে সর্বোচ্চ দরদাতাকে ইজারা দেওয়া হয়েছে।
কম মূল্যে ইজারা দেওয়ার কারণ হিসেবে প্রতিবেদনের সুপারিশে বিষয়ে তিনি বলেন, সুনামগঞ্জ জেলার পাগলা-জগন্নাথপুর-আউশকান্দি সড়কের রাণীগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর উপর নির্মিত ‘রাণীগঞ্জ’ সেতু চালু হওয়াতে যানবাহন ওই সেতু দিয়ে চলাচল করছে। যে কারণে বর্তমানে বিশ্বনাথ উপজেলার ‘লামাকাজী’ সেতু দিয়ে দিয়ে গাড়ি চলাচল ‘কমে’ গেছে। এজন্য আগেরমত টোল ‘আদায় হচ্ছে না। এ কারণে ইজারার অর্থ অর্ধেকের মত কমে গেছে।
সেতুটি ইজারার মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর আওয়ামী লীগের নেতারা মাত্র ৫ কোটি টাকায় ইজারা নিয়ে টোল আদায় করেছেন এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি তা অস্বীকার করেন। বলেন, এটা আমি আগে শুনিনি।
স্থানীয়দের ভাষ্য, জুলাই থেকে সওজ নিজেই টোল আদায় করছে। বর্তমানে প্রতিদিন ঠিক কত গাড়ি যাচ্ছে এবং কত টাকা টোল উঠছে তার সঠিক হিসাব প্রকাশ করা হচ্ছে না। এখানে ‘অনিয়মের’ গন্ধ রয়েছে।
সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের বিশ্বনাথ উপজেলার লামাকাজিতে সুরমা নদীর উপর নির্মিত এমএ মাহবুব সেতুতে ১৯৯০ সালের ৩ আগস্ট থেকে টোল আদায় শুরু হয়। সর্বশেষ ২০২১ সালে ৩ বছরের জন্য ১৮ কোটি ৭২ লাখ টাকায় সেতুটি ইজারা দেয়া হয়েছিল। চলতি বছরের ৩০ জুন ইজারার মেয়াদ শেষ হয়। ফলে সড়ক ও জনপদ বিভাগ সেতুটি পুনরায় ইজারা দেয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পরই ২ সেপ্টেম্বর ইজারা আহ্বান করলে মাত্র ৪টি প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে। কৌশলে ৪টি প্রতিষ্ঠানের ‘সমঝোতায়’ পূর্বেকার ইজারার অর্ধেক মূল্যে টেন্ডার দেয়। তা অনুমোদনের জন্য বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নেওয়া হয়। কিন্তু টেন্ডারে অংশগ্রহণ করতে পারেনি এমন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের তৎপরতায় ১২ নভেম্বর পুনরায় কোটেশন আহ্বান করে সিলেট সড়ক বিভাগ। তাতেও সিন্ডিকেটদের সুবিধাবাদীচক্র নানা রকম চাপ সৃষ্টি ও হুমকি-ধামকি দিয়ে অন্যান্য দরপত্র ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সরিয়ে দেয়। কোনোভাবেই ৩০টি দরপত্র ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান টেন্ডার জমা দিতে পারেনি। টেন্ডার জমাদানকারী দুইটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে, মাহি এন্টারপ্রাইজ ও হক এন্টারপ্রাইজ। এরমধ্যে মাহি এন্টারপ্রাইজ টেক্স ভ্যাট ছাড়া ১০ কোটি ৬ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা ও হক এন্টারপ্রাইজ ১০ কোটি ৩ লাখ ৩৬ হাজার ৫৫০ টাকা মূল্যে টেন্ডার জমা দেয়। সর্বোচ্চ দরপত্রদাতা প্রতিষ্ঠান মাহি এন্টারপ্রাইজ নিয়মানুসারে ইজারা পায়। গুরুত্বপূর্ণ এই সেতুটি কম মূল্যে ইজারা প্রদান করায় সরকারের প্রায় ১০ কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে।
উল্লেখ্য, বর্তমানে এই সেতুতে প্রতি মিনিটে অসংখ্য ছোট-বড় যানবাহন চলাচল করে। আসা-যাওয়ায় প্রতিটি লরি ২৫০ টাকা, ট্রাক ৭৫ টাকা, ঢাকাগামি বাস ৭০ টাকা, লোকাল বাস ৫০ টাকা, পিকআপ ৮০ টাকা, নোয়া-লাইটেস ৮০ টাকা, কার ৪০ টাকা, সিএনজি অটোরিকশা ২০ টাকা টোল আদায় করা হয়। সে হিসেবে বর্তমানে সেতুটি ২০ কোটি টাকার উপরে লিজ প্রদান করা হলেও লোকসানের কোনো সম্ভাবনা ছিল না, এমন দাবি স্থানীয় জনসাধারণের।