সিলেটে বিদ্যুতের ভেল্কিবাজির সাথে তীব্র তাপদাহ
এহিয়া আহমদ, অতিথি প্রতিবেদক :: গত কয়েকদিন ধরে ভাদ্র মাসের রৌদ্রের খরতাপে পুড়ছে সিলেটবাসী। এরমধ্যে যোগ হয়েছে অসহনীয় লোডশেডিং। কয়েকদিন থেকে সিলেটে ভয়াবহ তাপদাহ আর অতিরিক্ত বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের জন্য জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেছে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিংয়ে চরম দুর্ভোগে রয়েছেন সাধারণ মানুষ। অস্বাভাবিক গরম আর অতিরিক্ত তাপদাহে হালকা বাতাস যেন গায়ে বইছে আগুনের উল্কার মতো। একদিকে প্রচÐ গরমের তাপদাহ অন্যদিকে দিবারাত্রি বিদ্যুতের নজিরবিহীন খেলায় দিশেহারা হয়ে পড়ছেন সবাই।
বিশেষ করে এই প্রখর রোদে অতিরিক্ত লোডশেডিংয়ে বয়োবৃদ্ধ ও শিশুদের জীবনে নেমে এসেছে অশান্তি। দিনের বেলায় তীব্র তাপদাহে ঘর থেকে বাইরে বের হওয়া যেন দায় হয়ে পড়েছে। বিশেষ কোনো কাজ ছাড়া দিনের বেলায় সিলেটবাসীকে খুব একটা বাইরে দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে ঘরে ঘরে বিদ্যুতের এই আসা-যাওয়ার ঝলকানিতে ক্ষোভে ফেটে ওঠছেন জনসাধারণ। দিনমজুর, রিকশাচালক আর নিম্ন আয়ের মানুষজন প্রচুর কষ্টে দিনযাপন করছেন। সব মিলিয়ে কাঠফাঁটা এই রৌদ্রের তীব্র গরমের সাথে লোডশেডিংয়ের জন্য অস্বস্তিতে আছেন সাধারণ মানুষ। অতিরিক্ত লোডশেডিং থাকায় সিলেটের বিভিন্ন স্থানের বাসা-বাড়িসহ আবাসিক-অনাবাসিক হোটেলগুলোতে দেখা দিয়েছে ব্যবহৃত পানির সংকট। সেই সাথে বাসা-বাড়িতে দেখা দিচ্ছে বিশুদ্ধ পানির অভাব।
স্টেশনারী দোকানের ব্যবসায়ীদের ফটোস্ট্যাট মেশিন, বাসাবাড়ির ফ্রিজ, টিভি ও কম্পিউটারসহ বিভিন্ন দামি দামি জিনিসপত্র নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। বেশি সময় বিদ্যুৎ না থাকলে ইন্টারনেট সেবাতেও দেখা দিচ্ছে বিঘœতা। লাগাতার লোডশেডিংয়ের জন্য ব্যাংক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অফিসে ব্যহত হচ্ছে কর্মঘণ্টা। এজন্য ক্ষোভ প্রকাশ করছেন সেবা নিতে আসা ভুক্তভোগীরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, অতিরিক্ত গরমে বেশি কষ্টে রয়েছেন খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। গত কয়েকদিনে সকাল থেকে বেলা গড়ানোর সাথে সাথে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে সিলেট নগরী। রাস্তাঘাটে মানুষের চলাচল কমে যায়। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাইরে বের হচ্ছেন না। বাইরে বের হওয়া দিনমজুর ও শ্রমজীবী মানুষেরা নিজেকে সতেজ রাখতে একটু পরপর পান করেছেন পানি। অনেকে আবার সড়কের পাশে বিক্রি করা ডাব, আইসক্রিম ও লেবুর শরবত পান করে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ রাখছেন।
নগরীর তোপখানা এলাকার রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী জামাল মিয়া জানান, ‘এমনিতেই রুজি-রোজগার নেই। তার ওপর তীব্র গরমের সাথে প্রতিনিয়ত ৮-১০ ঘণ্টার অনাকাক্সিক্ষত লোডশেডিং। প্রচÐ রোদ ও গরমের মধ্যে ব্যবসার অবস্থা একেবারেই নাজুক। কয়েকদিনের অতিরিক্ত গরমে আর বিদ্যুৎ বিভ্রাটের জন্য ঠিকমতো কাজ করতে পারছি না।’
নগরীর বন্দরবাজারের ব্যবসায়ী খোকন বলেন, ‘আজ অফিসে এসেই দেখি বিদ্যুৎ নেই। ঘণ্টা দেড়েকের পর দিল তো আবার নিয়ে নিল। এভাবে প্রতি ঘণ্টা পরপর বিদ্যুৎ দিচ্ছে আর নিচ্ছে। অন্যদিকে পড়েছে ভ্যাপসা গরম। ফ্যান চালিয়েও অফিসে টিকে থাকা মুশকিল। আর বিদ্যুতের এই ভেল্কিবাজিতে উপায় নেই কাজ করার। এভাবে চলতে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বে মানুষজন।’
এদিকে সিলেট আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, সিলেটের আকাশ আংশিক মেঘলা থেকে মেঘলা রয়েছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় অস্থায়ী দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি বা বজ্রবৃষ্টিসহ অনেক জায়গায় মাঝারি থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে। আর দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
সিলেটে বিদ্যুৎ-বিভ্রাট লোডশেডিংয়ের কারণে বিপাকে পড়েছেন বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) শিল্পনগরীর উদ্যোক্তারা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদনে ধস নেমেছে। এভাবে চলতে থাকলে উৎপাদন বন্ধ করা ছাড়া উপায় থাকবে না বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা।
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, ‘একদিকে উৎপাদন কম, অন্যদিকে চাহিদা বাড়ায় বেড়েছে লোডশেডিং।’ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে আরও কিছুদিন। মঙ্গলবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত সিলেট জোনে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৯০.৬০ মেগাওয়াট। কিন্তু সরবরাহ করা হয়েছে ১৩৬.৮৫ মেগাওয়াট। চাহিদার তুলনায় ২৮.২০ শতাংশ কম বিদ্যুৎ পেয়েছে সিলেট জোন। এছাড়া সিলেট জেলায় মঙ্গলবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ১৩৪.৭২ মেগাওয়াটের বিপরীতে সরবরাহ করা হয়েছে ৯৩.৬৬ মেগাওয়াট। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় সিলেট জেলায় ওই সময়ে ৩০.৪৭ শতাংশ কম বিদ্যুৎ পেয়েছে।
সিলেট বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) সূত্র জানায়, সিলেট বিভাগে পল্লী বিদ্যুৎ ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের গ্রাহক রয়েছেন প্রায় ২৬ লাখ। ন্যাশনাল লোড ডেসপ্যাচ সেন্টার থেকে চাহিদার থেকে কম বিদ্যুৎ সরবরাহ করলে পিক আওয়ারে লোডশেডিং করা হয়। দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ধরা হয় ডে-পিক আওয়ার। বিকল ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্তও থাকে পিক আওয়ার। পিক আওয়ারের হিসেবে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ না পেলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কমপক্ষে ১১ ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হয় সিলেট বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষের। অপরদিকে প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ হয়ে গ্রাহকরা ক্ষিপ্ত হন স্থানীয় বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। অনেক সময় দায়িত্বরত প্রকৌশলী, অন্যান্য কর্মকর্তা কর্মচারীদের উপর চড়াও হন ক্ষুব্ধ গ্রাহকরা। অনেকেই আবার ফোন করে ধমক দিয়ে থাকেন বলে জানান সিলেটের বিভিন্ন বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে সোমবার এক বিবৃতিতে নগরীর বিসিক শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি কাজী মঈনুল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক আলীমুল এহছান চৌধুরী জানান, গোটাটিকর বিসিক শিল্পনগরী এলাকায় হিমাগার, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারক শিল্পসহ বিভিন্ন ধরনের প্রায় ৪৫টি শিল্প কারখানা রয়েছে। প্রতিদিন সেখানে চলছে উৎপাদন কার্যক্রম। এসব কারখানায় প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিক কর্মরত। এক সপ্তাহ ধরে শিল্পনগরী এলাকায় ভয়াবহ লোডশেডিং চলছে। আগে যেখানে সারা মাসে ১৫-২০ ঘণ্টা লোডশেডিং হতো, সেখানে বর্তমানে দৈনিক ৮-১০ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। এভাবে বিদ্যুৎবিভ্রাটের কারণে কারখানাগুলোর উৎপাদনব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ব্যহত হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উৎপাদনব্যবস্থা ব্যহত হওয়ার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকমতো শ্রমিকদের পারিশ্রমিক দিতে পারছে না। এ ছাড়া ব্যাংক ঋণের টাকায় নির্মিত প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আহŸান জানান তাঁরা।
সিলেট বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. আবু হোসাইন জানান, মঙ্গলবার বিদ্যুৎ বিভাগের একটি অভ্যন্তরীণ সভা হয়েছে। ওই সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক সিলেটের বিদ্যুতের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিষয়টি সেন্ট্রালে (ঢাকা) জানানো হবে।
সিলেটের বিভাগীয় বিদ্যুৎ অফিসের সহকারী প্রকৌশলী মো. জারজিসুর রহমান রনি বলেন, ‘বিদ্যুতের জ্বালানিস্বল্পতার কারণে এই লোডশেডিং হচ্ছে, যে কারণে আমরা পর্যাপ্ত চাহিদা পূরণ করতে পারছি না। সিলেটে শনিবার ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ লোডশেডিং হয়েছে। এ রকম অবস্থা আগামী নভেম্বর পর্যন্ত চলার সম্ভাবনা রয়েছে।’
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) সিলেট বিতরণ বিভাগ-২এর নির্বাহী প্রকৌশলী শামস-ই আরেফিন বলেন, ‘এই লোড মেনেজন্টে করে এনএলডিসি। তারা আমাদের বলে লোড মাপা হবে। কোনো লাইন বন্ধ করবেন না। সব চালু থাকবে। কিন্তু আমাদের বক্তব্য ছিল মিটারে ইতোমধ্যে সর্বোচ্চ লোড রেকর্ড হওয়া আছে। আপনার এই ডিমান্ড থেকে লোড দেন। কিন্তু তারা এটা থেকে নেয় না। মনে করেন আপনার বাসায় সারাদিন বিদ্যুৎ থাকলে বাসার এসি, ফ্রিজ, আইপিএস, লাইট ফ্যান সব চার্জ হয়ে থাকবে। তখন তারা কোনো লোড নেবে না। কিন্তু যখন বিদ্যুৎ থাকবে না তখন এসব বিদ্যুৎ নেওয়া শুরু করবে। তাহলেতো চাহিদা বেড়ে যাবে। ওই গ্যাপটা কারো নজরে আসতেছে না। আমরা চাচ্ছি সিলেটে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়াতে। আমরা আগেও এ বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। মন্ত্রণালয়ের অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি যারা ভিজিট করতে আসে তাদের মিটিং, ডিসি অফিসের মিটিংয়েও আমি এই লোড বরাদ্দের বিষয়টা নিয়ে বলেছি লছি কিন্তু কিন্তু তৎকালীন ডিসি সাহেব ধমক দিয়ে আমাকে চুপ করিয়ে দেন। উনি। উনি বলতেন বিদ্যুৎ নিয়ে কোনো কথা বলবেন না। বেশি বিদ্যুৎ পাচ্ছে সিলেট।’
এ ব্যাপারে সিলেট বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল কাদির বলেন, ‘বিদ্যুতের লোড ম্যানেজমেন্ট আমাদের হাতে নেই। দীর্ঘদিন ধরে আমরা আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়টা বুঝানোর চেষ্টা করছি। আমরা আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে অবগতও করেছি। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। অথচ এই লোডশেডিংয়ে আমাদের কোনো হাত নেই। তারপরও জনগণের ক্ষোভের শিকার আমরাই হই।