নিজস্ব প্রতিবেদক :: ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে সীমান্ত দিয়ে চোরাচালান কারবার। গরু, মহিষ, চিনিসহ ৩০ থেকে ৪০ ধরনের পণ্য আনা হচ্ছে। যাচ্ছে ইলিশ মাছ, শিং মাছ, দেশীয় রসুন, মটরশুটি, জিরাসহ নানা ধরনের পণ্য। এতে দেশের অসামান্য ক্ষতিও হচ্ছে। রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। শুল্ক ফাঁকি দিয়ে এসব চোরাচালানের কারণে দেশের নিত্যপণ্যের উপর পড়ছে প্রভাব। অন্যদিকে গবাদি পশু গরু-মহিষ নিয়ে আসার ফলে দেশীয় খামারিরা পড়ছেন বিপাকে। হচ্ছে অপূরণীয় ক্ষতি। রোগবালাই ছড়াচ্ছে দেশীয় গরুর মধ্যে। শুধু তাই নয়, সীমান্ত দিয়ে চোরাকারবারিরা পাচার করছেন নারী, পুরুষ, রাজনীতিবিদদেরও। এসব কারণে অরক্ষিত হয়ে পড়ছে সিলেটের সীমান্তগুলো।
গত দু’দিনে বিজিবি, পুলিশ ও যৌথ বাহিনীর পৃথক পৃথক অভিযানে কয়েক কোটি টাকার মতো পণ্য জব্দ করা হয়। এর মধ্যে মাছ, জিরা, দেশীয় রসুনসহ ভারতীয় শাড়ি-কাপড়, মাদক ইত্যাদি।
সিলেটের সীমান্তে পৃথক পৃথক অভিযান পরিচালনা করে চোরাচালানের মালামাল জব্দ করছে সিলেট ব্যাটালিয়ন (৪৮ বিজিবি)।
বুধবার ও বৃহস্পতিবার সিলেট ব্যাটালিয়নের (৪৮ বিজিবি) আওতাধীন সিলেটের গোয়াইনঘাটসহ বিভিন্ন সীমান্তে বিজিবি’র বিশেষ অভিযানে প্রায় সোয়া কোটি টাকার ভারতীয় পণ্য জব্দ করে।
একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে অভিযানের বিষয়টি নিশ্চিত করেন সিলেট ব্যাটালিয়ন ৪৮ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোঃ হাফিজুর রহমান, পিএসসি।
বিজিবির সূত্রে জানা যায়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ৯ ও ১০ অক্টোবর সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার পানতুমাই বিওপি ও প্রতাপপুর বিওপিসহ সিলেটের বিভিন্ন সীমান্তে পৃথক অভিযান চালিয়ে ভারতীয় থ্রী-পিস ২০১টি, টি শার্ট-২৭০ পিস, গরু ৭টি, চিনি ১০১৮০ কেজি, বিড়ি ১৬০০ প্যাকেট, মদ ৯৩ বোতল, মোটর সাইকেল ১টি, ট্রাক ১টি, মাহিন্দ্রা ১টি এবং বাংলাদেশি রসুন ৪২৭৫ কেজিসহ অন্যান্য মালামাল জব্দ করতে সক্ষম হয়। যার আনুমানিক সিজার মূল্য ১ কোটি ১৪ লক্ষ ৫৮ হাজার ২ শত ৫০ টাকা।
সিলেট ব্যাটালিয়ন (৪৮ বিজিবি) এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোঃ হাফিজুর রহমান, পিএসসি বলেন, উর্ধ্বতন সদরের নির্দেশনা অনুযায়ী সীমান্তে নিরাপত্তা রক্ষা ও চোরাচালান প্রতিরোধে বিজিবি’র আভিযানিক কার্যক্রম ও গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় সীমান্তবর্তী এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে এসব চোরাচালানের মাল জব্দ করা হয়। জব্দকৃত মালামাল স্থানীয় কাস্টমস এ জমা করার প্রক্রিয়া চলছে।
১৩ লাখ টাকার ভারতীয় জিরাসহ যুবক আটক-
সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুরে ৭২ বস্তা ভারতীয় জিরাসহ আব্দুল মালেক বাবুল (৩২) নামে এক যুবককে গ্রেফতার করেছে যৌথ বাহিনী। বৃহস্পতিবার ভোর রাতে উপজেলার কারেন্টের বাজারে অভিযান পরিচালনা করে জিরাসহ তাকে আটক করা হয়। গ্রেফতারকৃত আব্দুল মালেক উপজেলার পশ্চিম কাঁছিরগাতি গ্রামের বাসিন্দা।
পুলিশ জানায়, বিশ্বম্ভরপুর থানার এসআই মো. মতিয়ার রহমান ও আর্মি ক্যাম্পের ক্যাপ্টেন মো. তরিকুল ইসলামের যৌথ নেতৃত্বে কারেন্টের বাজারে অভিযান পরিচালনা করে আটককৃত আসামির দোকানের গোডাউন তল্লাশি করে ২ হাজার ১৬০ কেজি (৭২ বস্তা) ভারতীয় জিরা জব্দ করা হয়। জব্দকৃত জিরার বাজার মূল্য ১৩ লক্ষ টাকা। এসময় আব্দুল মালেক বাবুল জব্দকৃত ভারতীয় জিরা আমদানি সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেননি।
বিশ্বম্ভরপুর থানার ওসি কাউসার আলম জানায়, শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশে এনে ভারতীয় জিরা নিজ হেফাজতে রাখায় তার বিরুদ্ধে বিশ্বম্ভরপুর থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃত আসামিকে বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে।
১৪ লাখ টাকার চোরাই চিনি জব্দসহ আটক ২-
সিলেট-তামাবিল সড়কের পীরেরবাজার থেকে একটি ট্রাক তল্লাশি করে চোরাই চিনির এই চালানটি জব্দ করে শাহপরাণ থানা পুলিশ। এসময় দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার চৌপুকুরিয়া গ্রামের মৃত আব্দুল মালেকের ছেলে মো. মাসুদ মিয়া (৪৪), একই জেলার কোতোয়ালি থানার পশ্চিম শিবরামপুর গ্রামের জালাল উদ্দিনের ছেলে মো. মোকারম হোসেনকে (৩৪) আটক করা হয়। তারা দু’জনই ট্রাকটির চালক ও হেল্পার। চোরা চালানের কাজে ব্যবহৃত ট্রাকটিও জব্দ করা হয়েছে।
গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম শাখা জানায়, বুধবার সকালে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শাহপরান থানার শাহপরান মাজার পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের একদল সদস্য সন্দহজনক একটি ট্রাক (ঢাকা মেট্রো. ট-২৪-৪৯২৬) তল্লাশি করে ২৩৭ বস্তা ভারতীয় চিনি জব্দ করে। তাদের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দায়ের করে আদালতে সপোর্দ করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম।
চোরাই ১০৯ বস্তা ভারতীয় চিনিসহ আটক ৩ জন জেলে-
ওসমানী বিমানবন্দর সড়ক থেকে ১০৯ বস্তা ভারতীয় চোরাই চিনি বোঝাই ট্রাক জব্দ করেছে পুলিশ। বুধবার সকালে আম্বরখানা-বিমানবন্দর সড়কের সিলেট ক্যাডেট কলেজের সামনে থেকে ভারতীয় চিনির এই চালানটি জব্দ করে এয়ারপোর্ট থানা পুলিশ। এসময় তিনজনকে আটক করে পুলিশ। আটককৃতরা হলেন- গোয়াইনঘাট উপজেলার টেকনাগুল গ্রামের লিলু মিয়ার ছেলে রুবেল মিয়া (২৫), শাহজাহানের ছেলে হৃদয় আহমেদ (২১) ও হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার কসবা গ্রামের ইলন রবি দাসের ছেলে সাজু রবি দাস (২২)।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বুধবার সকালে সিলেট ক্যাডেট কলেজের সামনে সিলেট নগরমুখী একটি ট্রাক আটক করে পুলিশ। পরে ট্রাকের ভেতর থেকে ১০৯ বস্তা (৫২৩২ কেজি) ভারতীয় চিনি জব্দ করা হয়। গ্রেফতারকৃত আসামীদের বিরুদ্ধে এয়ারপোর্ট থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা রুজু করা হয়েছে। বুধবার আসামীদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে।
ইউপি চেয়ারম্যানের গোডাউন থেকে ২৩১ বস্তা চিনি উদ্ধার-
মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার কামারচাক ইউপি চেয়ারম্যান আতাউর রহমানের গোডাউন থেকে ২৩১ বস্তা ভারতীয় চিনি উদ্ধার করা হয়েছে। আতাউর মৌলভীবাজার সদর আসনের সাবেক এমপি জিল্লুর রহমানের ছোট ভাই। তবে এসময় আতাউরকে না পেলেও পুলিশ মছকন মিয়া (৩৫) নামে একজনকে আটক করেছে।
বৃহস্পতিবার উপজেলার কামারচাক ইউনিয়নের তারাপাশা বাজারের পূবালী ব্যাংকের নিচতলায় পুলিশ এই অভিযান পরিচালনা করে।
রাজনগর থানার ওসি শাহ মো. মোবাশ্বির জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আতাউর চেয়ারম্যানের গোডাউনে অভিযান পরিচালনা করা হয়। সেখান থেকে ২৩১ বস্তা ভারতীয় চোরাই চিনি জব্দ করা হয়। সিলেট সীমান্ত এলাকা থেকে চোরাই পথে চিনিগুলো আমদানি করে বিক্রির উদ্দেশ্যে এই গোডাউনে মজুত করে রাখা ছিল। এই ঘটনায় আটককৃত মছকন মিয়া ও পলাতক চেয়ারম্যান আতাউর রহমানসহ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রাজনগর থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। পলাতক আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
উল্লেখ্য, ৫ আগস্টের পর থেকে সাবেক এমপি জিল্লুরসহ তার সব ভাই আত্মগোপনে চলে যান। সাবেক এমপিসহ তাদের সব ভাই একসময় বিএনপির রাজনীতি করতেন। কিন্তু গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তারা সবাই আওয়ামী লীগ রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং টাকার বিনিময়ে ইউপি চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদ সদস্য ও এমপি পদ বাগিয়ে নেন।
গোয়াইনঘাট সীমান্তে নারীসহ আটক ৪-
ভারতে অনুপ্রবেশের ছয় মাস পর ফেরার পথে গোয়াইনঘাট সীমান্ত এলাকা থেকে এক নারীসহ ৪ জনকে আটক করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
গত বুধবার সন্ধ্যায় সিলেট ব্যাটালিয়ন ৪৮ বিজিবির সদস্যরা গোয়াইনঘাট এলাকার সীমান্তবর্তী রানীরঘাট এলাকা থেকে তাদের আটক করেন। আটককৃতরা হলেন- চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার ভাইয়ারপাড়া গ্রামের মো. জহির উদ্দীন (২৯), তার স্ত্রী আফরোজা সুলতানা (২২), নোয়ারভিলা গ্রামের মো. রাকিবুল ইসলাম (১৮) এবং পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার বাহেরচর গ্রামের মো. মিরাজ (২৭)।
বিজিবি সূত্রে জানা যায়, বিজিবি ৪৮ ব্যাটালিয়নের সংগ্রাম বিওপির সদস্যরা গোয়াইনঘাটের ১২৭২/৫ ভারত সীমান্ত পিলারের রানীরঘাট এলাকায় বাংলাদেশের ভেতর থেকে বুধবার সন্ধ্যায় ওই ৪ জনকে আটক করেছেন। আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে, ছয় মাস আগে কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে তারা ভারতে গিয়েছিলেন।
বিজিবি সিলেট ৪৮ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. হাফিজুর রহমান বলেন, আটক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে গোয়াইনঘাট থানায় অনুপ্রবেশের অভিযোগে মামলা করে তাদের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।