নগরীর জিন্দাবাজার পয়েন্টে ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করছেন শিক্ষার্থীরা। ছবি: টুডে সিলেট।
চলছে দেশ সংস্কার, জনসাধারণের প্রশংসা
এহিয়া আহমদ :: মাত্র কয়েকদিন আগেও যেখানে লাঠি হাতে অধিকার আদায়ে নেমেছিলেন শিক্ষার্থীরা, এবার সেই শিক্ষার্থীরাই মাঠে নেমেছে ভিন্ন ভূমিকায়। যারা ছিলেন কলম হাতে নিজের সুন্দর জীবন গঠনের পথে, তারা এবার নামলেন সুন্দর শহর গড়তে। দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুলিশের অনুপস্থিতিতে সিলেটের বিভিন্ন সড়কে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। এতে সড়কে যানবাহন চলাচল অনেকটা গতি এবং স্বস্তি ফেরে সাধারণ মানুষের মধ্যে। পাশাপাশি সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষার্থীরা সড়ক ও আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত ও অপরিচ্ছন্ন জায়গাগুলো পরিষ্কার করছেন। শিক্ষার্থীদের এই ভূমিকা দেখে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশংসার অন্ত থাকছে না। পথচারী ও যানচালকরা তাদের বাহবা দিচ্ছেন। বুধবার সকাল থেকে সিলেট নগরীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে শিক্ষার্থীদের এমন কার্যক্রম দেখা গেছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, মহানগরীর আম্বরখানা, চৌহাট্টা, জিন্দাবাজার, বন্দরবাজার, রিকাবীবাজার, নয়াসড়ক, সোবহানীঘাট, নাইওরপুল, উপশহর, শেখঘাট পয়েন্ট, ভাতালি পয়েন্ট, সুবিদ বাজার পয়েন্ট, বাগবাড়ি পয়েন্ট, মদিনা মার্কেটসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সড়কে দাঁড়িয়ে ছাত্ররা যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছেন। কারো রাস্তা পার হতে সমস্যা হলে গাড়ি থামিয়ে পারও করে দেন।
প্রখর রোদে কেউ কেউ আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত ও অপরিচ্ছন্ন রাস্তার ময়লা পরিষ্কার করছেন আবার কেউ কেউ দায়িত্ব পালন করছেন রাস্তার যানজট নিরসনের। স্কুল-কলেজ ও মাদরাসা পড়–য়া শিক্ষার্থীরা এ যেন এক নতুন দেশ সংস্কারে বদ্ধ পরিকর হয়ে ওঠছেন। নেই কোনো ক্লান্তি, নেই কোনো বিরক্তি। মহানগরীর সৌন্দর্য বাড়াতে এবং সড়কের শৃঙ্খলা নিশ্চিতে কাজ করছেন এই তারুণ্য।
দেখা যায়, কেউ ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করলেই তারা চালকদের বাধা দিচ্ছেন। এতে করে রাস্তায় বড় ধরনের কোনো যানজট সৃষ্টি হচ্ছে না। পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা সাধারণ মানুষকে রাস্তা পারাপারে সহায়তা করছেন। শিক্ষার্থীদের এই চেষ্টাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন রাস্তায় চলাচলকারী সাধারণ মানুষ। এই দৃশ্য দেখা গেছে সিলেটের প্রধান প্রধান সড়কগুলোসহ নগরীর প্রত্যেকটি পয়েন্টে। শিক্ষার্থীদের এ কার্যক্রম দেখে সন্তুষ্টি প্রকাশ করছেন সাধারণ লোকজন।
এদিকে নগরীর আম্বরখানা ও নাইওরপুল ও চৌহাট্টা এলাকায় হেলমেট ছাড়া মোটরসাইকেল আরোহীদের ৫-১০ মিনিট অপেক্ষমান অবস্থায় দাঁড় করিয়ে রাখছেন শিক্ষার্থীরা। হেলমেট বিহীন মোটরসাইকেল চালানো ঝুঁকিপূর্ণ এমনটা বুঝিয়ে চালকদের হেলমেট পরার পরামর্শ দেন শিক্ষার্থীরা। এছাড়া শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি রাস্তা পরিষ্কার ও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজ করছেন ফায়ার সার্ভিস ও আনসার সদস্যরা।
মহানগরীর বিভিন্ন রাস্তায় দেখা গেছে, স্বেচ্ছায় তারা ট্রাফিক পুলিশের ভূমিকার পাশাপাশি পরিচ্ছন্নকর্মীরও দায়িত্ব পালন করছেন। রাস্তায় পড়ে থাকা ইটের টুকরা, অর্ধপোড়া কাঠ-টায়ার, যত্রতত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের খালি প্যাকেটসহ নানা ময়লা-আবর্জনা দিনভর পরিস্কার করছেন শিক্ষার্থীরা। অনেক শিক্ষার্থী ঝাড়ু হাতে রাস্তা ও ফুটপাত পরিস্কার করছেন।
দেশজুড়ে চলমান সংকটময় মুহূর্তে যখন বাংলাদেশ পুলিশ সদস্যরা কর্মবিরতিতে আছেন সেই মুহূর্তে শিক্ষার্থীদের এই ভূমিকা দেখে খুশি সাধারণ মানুষ ও পথচারীরা। সড়কে যানবাহনে চলাচলে শৃঙ্খলা ফেরানোর পাশাপাশি ধ্বংসস্তুপ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কাজ কিংবা রাত জেগে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পাহারার কাজে মুগ্ধ সবাই। নতুন প্রজন্মের হাত ধরেই নতুন করে দেশ ওঠুক এটিই চান সিলেটবাসী।
নগরীর চৌহাট্টা দিয়ে মোটরসাইকেল যোগে রিকাবী বাজার যাচ্ছিলেন সিয়াম আহমদ তপু নামের এক যুবক। তিনি বলেন, ‘সড়কে পুলিশ ও ট্রাফিক পুলিশ নেই। শিক্ষার্থীরা সড়কে গাড়ির নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নিয়েছেন। যা আমাদের জন্য খুব উপকার হয়েছে। এতে গাড়ি চলাচল অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে। তারা আসলে তাদের মতো করে চেষ্টা করছে। এটা কিন্তু প্রশংসনীয়। তারা নতুন বাংলাদেশ সংস্কারে নেমেছে। এটা দেখে সবার শেখা উচিৎ।’
ঝিনুক নামের এক পথচারী বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা দেখিয়ে দিয়েছেন, তাদের ক্ষমতা কত। তারা দেশটা এক প্রকার স্বাধীন করে দিয়েছে। আমি তাদের এই ভূমিকা নেওয়ার জন্য সাধুবাদ জানাই। তারা নতুন এক বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে। যেখানে সবাই মিলে-মিশে কাধে কাধ মিলিয়ে চলতে পারবে।’
পথচারী খোকন বলেন, ‘এমন সব দৃশ্য তাদের কাছে একাবারেই নতুন। তরুণ প্রজন্মকে সবাই মোবাইল আসক্ত, আর অলস হিসেবেই জানে। কিন্তু এই প্রজন্ম বিভিন্ন কার্যক্রম দিয়ে তাদের নতুন করে সবার কাছে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। নিজের জীবন দানের বিনিময়ে দেশকে দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীন করেছে। একটা দেশকে নতুন স্বপ্ন দেখিয়েছে। এই প্রজন্মই দেশকে সুন্দরভাবে সাজাবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।’
জিন্দাবাজারে বাজার করতে আসা এ.কে.এম হাসান বলেন, ‘কয়েক দিন পর বাজারে আসলাম। শিক্ষার্থীরা রাস্তাঘাট পরিষ্কার করছে। তারা হাতে ছোট লাঠি আর বাঁশি বাজিয়ে ট্রাফিক দেখাশোনা করছে এটা প্রশংসনীয়। মনে হচ্ছে আসল ট্রাফিক সদস্যরাই দায়িত্ব পালন করছে। তাদের ধন্যবাদও জানান তিনি।’
চৌহাট্টা এলাকায় ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করা সিলেট উইমেন্স মডেল কলেজের ফাস্ট ইয়ার শিক্ষার্থী হাদিয়া জান্নাত জাগ্রত সিলেটকে বলেন, দেশকে এখন আমাদের গোছানোর পালা। এই মুহূর্তে রাস্তায় কোনো পুলিশ বা ট্রাফিক পুলিশও নেই। রাস্তায় যাতে যান চলাচলে সমস্যা না হয় তাই আমরা শিক্ষার্থীরা ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করছি। আমাদের আশ-পাশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলো নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে দায়িত্ব পালন করছি। আমরা সবাইকে অনুরোধ করব সবাই যেন ট্রাফিক নিয়ম মেনে চলে।
বর্ডার গার্ড পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের ইন্টার ফাস্ট ইয়ারের শিক্ষার্থী সাবরিনা সুলতানা দিয়া জাগ্রত সিলেটকে জানান, দেশটা আমাদের তাই এই দেশের সংস্কার করার দায়িত্ব আমাদের। শুধু শিক্ষার্থীদের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না। আপনারা নিজে থেকে দেশ সংস্কারে এগিয়ে আসুন। শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষকে সহায়তা করুন। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা দেশের সবস্থানে ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি নিজস্ব নগরী পরিষ্কার করছেন। আমরা সুন্দর একটি বাংলাদেশ চাই। যেখানে কোনো বৈষম্য, কোনো অরাজকতা, কোনো রাহাজানি, কোনো দুর্নীতি থাকবে না। আপনারা আমাদের সহযোগিতা করুন।